জল দূষণ কাকে বলে: পরিবেশ দূষণ এখন সমাজের একটি মূল সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। বায়ু দূষণ এর পাশাপাশি জল দূষণ ও একটি বড় সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। আর এই সমস্যার সমাধান আমাদেরকেই করতে হবে।
কিন্তু তার আগে আমাদেরকে সমস্যা সম্পর্কে জানতে হবে। জানতে হবে জল দূষণ কাকে বলে, জল দূষণ এর কারণগুলি কি কি এবং জল দূষণের ফলে আমাদের কি কি ক্ষতি হচ্ছে।
এই আর্টিকেল এ আমরা এইসব ব্যাপারে বিস্তারিত জানবো। অবশ্যই আর্টিকেলটা পুরোটা পড়বেন। চলুন তাহলে প্রথমে জেনে নেওয়া যাক যে জল দূষণ কাকে বলে।
জল দূষণ কাকে বলে?
জলের আর এক নাম জীবন। জল ছাড়া উদ্ভিদ ও প্রাণী জীবন ধারণ করতে পারে না। কৃষিকাজ, মাছ চাষ এবং বিভিন্ন শিল্পে জলের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। বায়ুমন্ডলের মতোই বিভিন্ন অবাঞ্ছিত পদার্থ জলে মিশে জলকে দূষিত করে তুলেছে। নদ নদী, খাল বিল এবং সমুদ্রের জল নানাভাবে দূষিত হচ্ছে, মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণীদের জীবনধারণ করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
জলের সঙ্গে কোন অবাঞ্ছিত দ্রব্য মিশ্রিত হওয়ার ফলে যদি জলের ভৌত, রাসায়নিক ও জৈব বৈশিষ্ট্যসমূহ পরিবর্তন হয় এবং তার ফলে জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ ও মানুষের ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দেয় তবে জলের ঐরূপ দূরবস্থাকে জল দূষণ বলে। বিজ্ঞানী সাউথউইক এর মতে -“মানুষের ক্রিয়া-কলাপ এর ফলে এবং প্রাকৃতিক কারণে জলের ভৌত, রাসায়নিক এবং জৈব উপাদানগুলির গুণগত মান নষ্ট হয়ে যাওয়াই হল জলদূষণ।”
জল দূষণের কারণ
শিল্পঘটিত দূষণ: বড় বড় শহরে বেশিরভাগ শিল্প নদীর ধারে গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশে এইসব শিল্প কারখানা থেকে প্রতিনিয়ত ও তরল বর্জ্য পদার্থ জলে মিশে। এর ফলে জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এছাড়া ক্লোরিন, কস্টিক সোডা এবং কারখানার বর্জ্য পদার্থ গুলি জলকে বিষাক্ত করে তোলে।
গৃহস্থালী ও নর্দমা নিষ্কাশিত পদার্থ দ্বারা দূষণ: শহর বা নগরের প্রয় প্রণালীর আবর্জনা সাধারণত নদী, পুকুর এমনকি সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। নানারকম আবর্জনা নদীবক্ষে জমে ওঠে। যার ফলে উদ্ভিদ প্ল্যাংকটনের বৃদ্ধি ঘটে। উদ্ভিদ প্ল্যাংকটন মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেলে জলের অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। অক্সিজেনের অভাবে জলজ জীবদের মৃত্যুর হার বেড়ে যায়, ফলে নানা ধরনের রোগ জীবাণু বেড়ে গিয়ে বাস্তুতন্ত্রের অন্তর্গত সমস্ত উদ্ভিদ প্রাণীর মৃত্যু ঘটে। ভাগীরথী ও হুগলি নদীর তীরে যে শহরগুলি রয়েছে তা থেকে নির্গত বর্জ্য এসে নদীতে মেশে। কল্যাণী থেকে ডায়মন্ড হারবার এর মধ্যে ৩৫০টি নর্দমার বর্জ্য জল গঙ্গা নদীতে মিশেছে।
ঋষিভূমি থেকে নির্গত পদার্থ দ্বারা দূষণ: ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নাইট্রেট, ফসফেট সালফেট জাতীয় রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়। ব্যবহৃত সারের প্রায় 25% বৃষ্টির জলের সঙ্গে ধুয়ে পুকুর ও সমুদ্রের জলে মিশ্রিত হয়। কৃষি ক্ষেত্রে 200 র বেশি ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক, কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। শুধুমাত্র ভারতেই প্রতিবছর প্রায় 4000 টন সার জমিতে দেওয়া হয়।
সমুদ্র ও নদীর জলে তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত দূষণ: পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রভৃতি ক্ষেত্রেও শিল্পে শীতলীকরণের জন্য যে জল ব্যবহার করা হয়, সেই উত্তপ্ত জল সরাসরি নদী বা সমুদ্রে নিক্ষেপ করে। ফলে জলের তাপমাত্রা বেড়ে যায় ও জলজ বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস পায়। মাছেদের প্রজনন ক্ষমতা বিপর্যস্ত হয়।
ভাসমান তেল দ্বারা জলদূষণ: পেট্রোরাসায়নিক শিল্প কেন্দ্র থেকে নির্গত খনিজ তেল ও খনিজ তেলের উপজাত দ্রব্যগুলি সমুদ্র জলে মিশলে, জাহাজ ডুবি, তৈলবাহি ট্যাঙ্কার থেকে তেল জলে চুইয়ে পড়লে, সামুদ্রিক মহীসোপান থেকে খনিজ তেল উত্তোলনের সময় কিছু পরিমাণ জলে মিশে যায়। ফলে সমুদ্র থাকা প্রাণ গোষ্ঠী ও উদ্ভিদ গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাখিদের পালকে, ডানায় তেল লেগে যায়, পাখিদের ওড়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাই। এর ফলে পাখিদের শরীরের তাপমাত্রা কমে যায় এবং পাখিরা মারা যায়।
জল দূষণের ফলাফল
জল দূষণের ফলে জনজীবন অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এবং ভবিষ্যতেও এই ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়তে চলেছে। বর্তমানে জল দূষণের ফলে যে সকল সমস্যা হচ্ছে তা নিম্নরূপ।
মানব জীবনে জল দূষণের প্রভাব
(১) জল দূষণের ফলে মানবদেহে কলেরা, টাইফয়েড, জন্ডিস আমাশয়, আন্ত্রিক, হেপাটাইটিস, চর্মরোগ এবং আর্সেনিক দূষণজনিত রোগ প্রভৃতি মহামারীর আকার নেয়।
(২) লোহা, সাইনাইড, নিকেল, পারদ ক্লোরিন, তামা, প্রভৃতি জলে মিশ্রিত হলে, ওই প্রকার জল ব্যবহারের ফলে পেটের রোগ ও চর্মরোগ ঘটে।
(৩) জল পরিশোধন এর সময় ওই জলে বেশিমাত্রায় ফ্লুরিন মিশ্রিত হলে এবং ওই জাতীয় দূষিত জল পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত হলে, মানবদেহে এলার্জি, বৃক্কের রোগ, প্যারালাইসিস প্রভৃতি রোগ দেখা দেয়।
মৃত্তিকার উপর জল দূষণের প্রভাব
(১) দূষিত জলে কৃষিকাজে ব্যবহৃত হলে অনেক সময় মৃত্তিকাতে বসবাসকারী জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়ার ক্ষতি হয়। ফলে মাটি উর্বরতা শক্তি হারায়।
(২) দূষিত ভৌমজল অনেকক্ষেত্রে মৃত্তিকাতে ক্ষারের পরিমাণ বাড়ায়। ফলে মৃত্তিকার উর্বরতা হ্রাস পায়।
(৩) দূষিত জল উদ্ভিদ দেহে শোষিত হলে তা উদ্ভিদের শারীরবৃত্তিয় ক্রিয়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। এজন্য উদ্ভিদের শস্য উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং শস্যের গুণগত মান খারাপ হয়।
সামুদ্রিক পরিবেশের ওপর জলদূষণের প্রভাব
(১) সমুদ্রের জলে অপরিশোধিত তেল মিশিয়ে গিয়ে যে দূষণ ঘটায় তার ফলে মাছসহ অন্যান্য সামুদ্রিক জীব মারা যায়।
(২) অনেক সময় জল দূষিত হওয়ার ফলে জলজ উদ্ভিদের মধ্যে বিষাক্ত পদার্থ জমা হয়। যেমন ন্যাপথলিন, ফিনানথ্রিন, বেঞ্জোপাইরিন ইত্যাদি।
(৩) জল দূষিত হলে নির্দিষ্ট অঞ্চলের সামুদ্রিক বাস্তুরীতি বিঘ্নিত হয়। পাখিদের পালকের জলরোধী ক্ষমতার হ্রাস পায়। সেই জন্য পাখিদের শারীরিক উষ্ণতা কমে যায় এবং পাখিরা মারা যায়। এই অবস্থাকে বলে ‘হাইপোথারমিয়া।’
জল দূষণ নিয়ন্ত্রণের উপায়
(1) নালা নর্দমা এবং পয়ঃপ্রণালীর দূষিত জল সরাসরি নদী বা পুকুরের ফেলার পূর্বের শোধন করা দরকার। (2) কলকারখানার দূষিত রাসায়নিক পদার্থ গুলি যাতে নদীতে সরাসরি না ফেলা হয় সেই জন্য সরকারি পর্যায়ে কঠোর আইন প্রণয়ন করা দরকার। প্রয়োজনমতো ওই সব পদার্থগুলি শোধন করে তবে নদীতে ফেলা উচিত। (3) খনিজ তেল উৎপাদনের সময় তেল যাতে সমুদ্রের জলে না পড়ে অথবা তৈল বাহী নোংরা করা জাহাজ থেকে যাতে পরিতক্ত তেল সমুদ্রে না মেশে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। (4) খাল বিল যাতে কচুরিপানায় ভরে না যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। (5) পুকুর ও নদী-নালাতে স্নান ও বস্ত্র ধোঁয়া এবং পশু স্নান নিষিদ্ধ করতে হবে এবং প্রয়োজন হলে এই বিষয়ে সাধারণ মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে। (6) কৃষি জমিতে কীটনাশক ব্যবহার না করে জৈবিক পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত।
জল দূষণ নিয়ন্ত্রণ দু’রকম পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব,
ব্যক্তিগত উপায়ে জলদূষণ নিয়ন্ত্রণ
(১) কঠিন বর্জ্যবস্তু জলে না ফেলা।
(২) মলমূত্র, চিকিৎসা সম্পর্কিত আবর্জনা পুজোর ফল ও ফুল ইত্যাদি জলাশয় না ফেলা।
(৩) কাপড় কাচার জন্য কম ফসফেট যুক্ত ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা।
(৪) যে জলাশয় এর জল ব্যবহারের উপযোগী সেখানে গবাদি পশুর স্নান করানো বন্ধ করা দরকার।
(৫) বাড়ির আশেপাশের জলাশয় এ কচুরিপানা জন্মালে তৎক্ষণাৎ তা পরিষ্কার করতে হবে।
(৬) নর্দমার জল যাতে জলাশয় নাম এসে সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।
আইন সম্মত উপায়ে জলদূষণ নিয়ন্ত্রণ
1978 এবং 1977 খ্রিস্টাব্দে ‘জল দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ’ আইন চালু করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী যেসব শর্ত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে তা হল –
(১) 1974 খ্রিস্টাব্দের আইন অনুযায়ী নদী, পুকুর, কূপ বা খালি জমিতে আবর্জনা ফেলার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
(২) কোন শিল্প কারখানার বর্জ্য পদার্থ নিক্ষেপের জন্য নতুন কোন ইউনিট স্থাপন, পরিবর্তন বা প্রসারণ ঘটানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
(৩) বিভিন্ন কলকারখানায়, শিল্প সংস্থায় ব্যবহৃত জলের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য কোন নির্ধারক ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক।
জল দূষণের বিভিন্ন বিষয়গুলি দেখাশোনা করার দায়িত্ব অর্পিত হয় ‘কেন্দ্রীয় জল দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ’ এবং ‘রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ’- এর ওপর। এদের প্রধান কাজগুলি হল – (i) দূষণ সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া, (ii) বর্জ্য পদার্থ নির্গত করার নিয়ম ও পদ্ধতি নির্ণয় করা, (iii) দূষণের পরিমাণ পরিদর্শন করা।
পানীয় জল পরিশোধন করার উপায়: পানীয় জল পরিশোধন করার জন্য যেসব সহজ উপায় অবলম্বন করা দরকার, সেগুলি হল –
(1) জল কিছুক্ষণ ফুঁটিয়ে ঠাণ্ডা করে ছেঁকে নিতে হবে।
(2) ক্লোরিন, ব্লিচিং পাউডার ইত্যাদি ব্যবহার করে জল বিশুদ্ধ রাখা দরকার।
(3) জল ফিল্টার করে জলকে দূষণমুক্ত রাখা যায়।
(4) অ্যাকোয়াফিল্টারে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি ব্যবহার করে জল দূষণ মুক্ত করা যায়।
আশা করছি জল দূষণ (জল দূষণ কাকে বলে) সম্পর্কে আপনাকে সমস্ত প্রশ্নের সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পেরেছি। অবশ্যই পরিবেশ দুষণ সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে। কিন্তু তার আগে আমাদেরকে সমস্যাগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে।
নিচে কমেন্ট করে অবশ্যই আপনার মূল্যবান মতামত জানাবেন। AnswerChamp সাইটটি প্রতিদিন ফলো করবেন এই ধরনের সুন্দর সুন্দর তথ্য বাংলায় পাওয়ার জন্য। ধন্যবাদ।।