শব্দ দূষণ কাকে বলে: দিনের পর দিন আমরা যেভাবে পরিবেশ দূষণ এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যথাযথ ব্যবস্থা সঠিক সময়ে না নিলে খুব কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। একে একে বায়ু দূষণ, জল দূষণ, এবং শব্দ দূষণ আমাদেরকে খুবই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে চলেছে।
যথাসাধ্য ব্যবস্থা খুব তাড়াতড়ি নেওয়া দরকার। এই আর্টিকেল এ আমরা শব্দ দূষণ সম্পর্কে জানবো। জানবো শব্দ দূষণ কাকে বলে। অবশ্যই আর্টিকেলটা পুরোটা পড়বেন।
চলুন প্রথমে জেনে নেওয়া যাক শব্দ দূষণ কাকে বলে।
শব্দ দূষণ কাকে বলে?
শব্দ দূষণ কাকে বলে- মানুষের সক্ষমতার অতিরিক্ত সুরবর্জিত কর্কশ শব্দ যা মানুষের শারীরবৃত্তীয় স্বাভাবিক কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটায় এবং শরীর ও মনের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তাকে শব্দদূষণ বলে।
অন্যভাবে বললে মানুষের সহন ক্ষমতা বা শ্রুতি সীমার অতিরিক্ত তীব্র, তীক্ষ্ণ, অবাঞ্ছিত, কর্কশ এবং বেসুরের অশ্বস্থিকর শব্দকে শব্দ দূষণ বলে।
শব্দ দূষণের কারণ
বাজ পড়ার শব্দ এবং মেঘের গর্জন প্রভৃতি প্রাকৃতিক কারণ ছাড়া বেশিরভাগ শব্দ দূষণ মানুষের সৃষ্ট বিভিন্ন ক্রিয়ায় ঘটে। শব্দদূষণের প্রধান কারণ বা উৎসগুলি হল।
(১)যানবাহনের দ্বারা শব্দদূষণ: শব্দ দূষণের একটি অন্যতম কারণ হলো যানবাহন। বাস, লরি, মোটর গাড়ির, ট্রাম্প, টেম্পু প্রভৃতিক চলাচলের অস্বচ্ছন্দ সৃষ্টিকারী শব্দ এবং বিভিন্নপ্রকার বৈদ্যুতিক হর্ন এর তীব্রতা ও মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। তাছাড়া হাসপাতালে, বিদ্যালয় ও অন্যান্য নিরব কর্মব্যস্ত স্থানে শব্দদূষণ বাড়ছে।
(২) রেল পরিবহনের মাধ্যমে শব্দদূষণ: রেলগাড়ি একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়ার সময় এবং রেল স্টেশনে যাত্রী ওঠানামার সময় শব্দ দূষণ ঘটে। স্টেশনের সন্নিকটে যারা বসবাস করে, তারা এই শব্দ দূষণের প্রকোপে পরে। ট্রেনের হুইসেলের শব্দ কয়েক মাইল দূর থেকে শোনা যায়।
(৩) বিমান পরিবহনের দ্বারা শব্দদূষণ: এরোপ্লেন হেলিকপ্টার আকাশে ওড়ার সময় এবং আকাশপথে একস্থান থেকে অন্যস্থানে পরিবহনের সময় বিকট শব্দ সৃষ্টি করে। এছাড়া জেট বিমান ও সুপারসনিক বিমান চলাচলের শব্দ থেকেও শব্দদূষণ ঘটে।
(৪) বিভিন্ন শিল্প কলকারখানার যন্ত্রের মাধ্যমে শব্দ দূষণ: বিভিন্ন কলকারখানাতে যন্ত্রের বিকট আওয়াজ শব্দ দূষণের অন্যতম কারণ হিসাবে পরিগণিত হয়। যন্ত্রের আওয়াজ কারখানার শ্রমিকসহ কারখানা অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে শব্দদূষণ সৃষ্টি করে। এই সমস্ত কারখানায় মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং যন্ত্রপাতি তৈরীর কারখানা, টেক্সটাইল লুম, নিউজ পেপার প্রেস, চাবি, পাঞ্চিং মেশিন, গাড়ি সারাই কারখানা প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
(৫) যান্ত্রিক ক্রিয়াঘটিত দূষণ: ডিজেল চালিত জেনারেটর, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ওয়াশিং মেশিন, এয়ার কুলার, মিক্সি মেশিন, গম ভাঙ্গানো মেশিন, রাইস মিলের (ধান থেকে চাল তৈরির মেশিনের ক্রিয়া) থেকে উৎপন্ন শব্দ স্থানীয় অঞ্চলের মানুষের মধ্যে শব্দ দূষণ সৃষ্টি করে।
(৬) প্রতিবেশী ও দোকানপাট থেকে দূষণ: কোনো অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ যখন বাড়িতে জোরে জোরে টিভি চালায়, রেডিও চালায়, বা টেপ রেকর্ডার এ গান শুনে বা লাউডস্পিকার ব্যবহার করে তখন সেই শব্দ থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা বা প্রতিবেশীরা শব্দ দূষণের কবলে পড়ে।
(৭) কথোপকথনের মাধ্যমে দূষণ: বিভিন্ন অফিসে, শেয়ার বাজারে বা কোন মিটিং মিছিল বা জমায়েতে স্কুল-কলে কলেজে বা রেস্টুরেন্টে উচ্চস্বরে মানুষের কথোপকথন থেকে শব্দদূষণ ঘটে থাকে।
(৮) সামাজিক কারণে দূষণ: কোনো পূজা-পার্বণ বা বিয়ে বাড়ি উপলক্ষে, রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী বা কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যখন মাইক বাজানো হয় বা বাজি পোড়ানো হয়, তখন মাইক ও বাজির শব্দ থেকে শব্দ দূষণ ঘটতে থাকে।
শব্দ দূষণের ফলাফল
শব্দদূষণ মানবস্বাস্থ্যের ওপর বা মানবজীবনের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। অত্যাধিক শব্দের ফলে মানুষের মধ্যে বিরক্তিকর উদ্রেক হয়। অনেক সময় শব্দ দূষণের ফলে মানবদেহে অস্থায়ী বা স্থায়ী শারীরিক বা মানসিক রোগ সৃষ্টি হয়। আলোচনার সুবিধার জন্য মানুষের উপর শব্দদূষণের প্রভাবকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। তা হলো-
শব্দদূষণের অস্থায়ী প্রভাব
(১) কোনো কারনে উচ্চমাত্রার শব্দ মানুষের কর্ণের পর্দার সাময়িক ক্ষতি করে। এর ফলে অস্থায়ীভাবে মানুষের শ্রবণ ক্ষমতা নষ্ট হয়। দীর্ঘ সময় ৯০ ডেসিবেল শব্দের মধ্যে থাকলে আংশিক বধিরতা দেখা দেয়।
(২) দীর্ঘ সময় ধরে ১২৫ ডেসিবেল শব্দের নিকটে থাকলে কানের মধ্যে যন্ত্রণার উদ্রেক হয়।
(৩) অনেক সময় জেট বিমানের শব্দ, মাইকের আওয়াজ প্রভৃতির শব্দ শ্রবণে বাধার সৃষ্টি করে। একে মাস্কিং বলে।
শব্দ দূষণের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব
(১) শ্রবণযন্ত্রের ওপর প্রভাব: দেখা গেছে দীর্ঘদিন ১০০ ডেসিবেল শব্দের মধ্যে কাটালে বধিরতা দেখা দেয় কারণ অনেক সময় ১০০ ডেসিবেল শব্দের ফলে অন্তকর্ণের অর্গান অফ কর্টির শ্রুতি যন্ত্রের কোষগুলি একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া অনেকক্ষেত্রে 160 ডেসিবেল মাত্রার বিকট শব্দের ফলে কানের পর্দা পর্যন্ত ছিঁড়ে যায়। সেজন্য মানুষ স্থায়ীভাবে বধির হয়ে পরে।
(২) হৃদযন্ত্রের ওপর প্রভাব: দীর্ঘস্থায়ী বিকট আওয়াজ মানুষের হৃদযন্ত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এতে হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে যায় বা কমে যায়। শব্দদূষণের ফলে অনেক সময় ধমনীর রক্তের চাপও বেড়ে যায়।
(৩) শ্বাসকার্যের ওপর প্রভাব: শব্দদূষণের ফলে বহু মানুষের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের হার পরিবর্তিত হয়। উঁচু তীব্র শব্দের প্রভাবে শ্বাসক্রিয়ার গভীরতা ও বেড়ে যায়। এবং দ্রুত প্রশ্বাস গ্রহণ ও নিঃশ্বাস ত্যাগ হয়।
(৪) মস্তিষ্কের উপর প্রভাব: যন্ত্রণাদায়ক শব্দ মানুষের স্নায়ুতন্ত্র তথা মস্তিষ্ক ও সুষুম্নাকাণ্ডকে প্রভাবিত করে। অনেক সময় স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়, মানসিক অবসাদ দেখা দেয়। বিকট শব্দের ফলে মাথা ধরে শরীরের বিভিন্ন প্রকার উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া কারও না কারোর মধ্যে বমি ভাব ও খিচুনি ভাব দেখা দেয়। বিভিন্ন কাজে একাগ্রতা নষ্ট হয়।
(৫) চক্ষুর ওপর প্রভাব: শব্দদূষণের ফলে অনেক মানুষের দৃষ্টিশক্তির ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন রং এর আলো চেনার ক্ষমতা নষ্ট হয় অনেক সময় শব্দ দূষণের ফলে চোখের তারার রন্ধের প্রসারন ঠিকমতো হয় না।
(৬) পরিবেশের ওপর প্রভাব: শব্দদূষণের ফলে বহু প্রাণী ও পাখি প্রজননে অংশ নিতে পারে না। ফলে ওই পাখি ও প্রাণীর নতুন অপত্য পৃথিবীতে আসে না। সেজন্য পরিবেশের বাস্তুরীতির ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় এবং তার প্রভাব মানুষের মধ্যেও পড়ে।
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের উপায়
শব্দদূষণ নিম্নলিখিত উপায়ে নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করা যায়। যথা – (১) প্রযুক্তিগত উপায়ে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ, (২) আইনসম্মত উপায়ে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ, (৩) পরিবেশগত উপায়ে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং (৪) জনশিক্ষার মাধ্যমে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ।
প্রযুক্তিগত উপায়ে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ
(i) বিভিন্ন কলকারখানার বা শিল্পসংস্থার পুরানো আমলের উচ্চ শব্দ বা কর্কস শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্রের প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটিয়ে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করা যায়।
(ii) অনেকক্ষেত্রে যেসব যন্ত্রপাতি থেকে অবাঞ্ছিত শব্দ উৎপন্ন হয় সেসব যন্ত্রপাতির ওপর শব্দ নিয়ন্ত্রণকারী আচ্ছাদনের ব্যবহারের মাধ্যমে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
(iii) যেসব মানুষ বিভিন্ন শিল্পে বা অন্যাস্থানে যেখানে ৪০ ডেসিবেলের বেশি শব্দের প্রভাব রয়েছে সেখানে কাজ করেন, তাদের জন্য শব্দ প্রতিরোধক ইয়ার প্লাগ, ক্যানাল কাপ এবং ইয়ার মাফ ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে শব্দ দূষণ ওইসব মানুষের ওপর তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
(iv) যেসব শিল্পকারখানায় প্রচন্ড শব্দ উৎপন্ন হয় সেখানে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধের জন্য শব্দ প্রতিরোধী অঞ্চল তৈরি করা প্রয়োজন হয়।
(v) গাড়ির হর্নের তীব্র আওয়াজ প্রতিরোধ করার জন্য সাইলেন্সার লাগাতে হবে।
আইনসম্মত উপায়ে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শব্দদূষণ বিরোধী আইন প্রচলিত হয়েছে। ভারতের হাসপাতাল, বিচারালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে সৃষ্টি করা আইনত নিষিদ্ধ। এছাড়াও অন্যান্য স্থানের জন্য শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণকারী কিছু বিধি-নিষেধ আছে। কলকাতা হাইকোর্ট এই বিধি নির্দেশিকা প্রকাশ করে। শুধু তাই নয়, ‘মোটর ভেহিকেলস অ্যাক্ট’ অনুযায়ী বসতি অঞ্চলে গাড়ি চালানোর সময় হর্ন ব্যবহারের মাত্রা ও নির্দিষ্ট করা আছে।
পরিবেশগত উপায়ে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ
(i) গাছপালা শব্দ শোষণ করতে পারে তাই শহরাঞ্চলে রাস্তার দু’ধারে গাছপালা লাগিয়ে শব্দদূষণ রোধ করা হয়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, তেতুল, বট, অশোক, নিম, নারকেল, দেবদারু প্রভৃতি উদ্ভিদ বেশি মাত্রায় শব্দ শোষণ করে।
(ii) বর্তমানে শহর অঞ্চলের অনেক বাড়িতে ঘরের প্রাচীর এবং ছাদ শব্দ নিরোধক দ্রব্য দ্বারা আচ্ছাদিত করা হয়। এর ফলে শব্দদূষণ কিছুটা প্রতিরোধ করা যায়।
জনশিক্ষার মাধ্যমে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ
(i) বিভিন্ন প্রকার গণমাধ্যমের সহায়তায় প্রচারের দ্বারা শব্দ দূষণের কুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করলে শব্দদূষণ কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয়।
(ii) বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ৬৫ ডেসিবেল এর নিচে মাইক বাজানো হলে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রিত হয়।
(iii) আতশবাজি পোড়ানো, পটকা ফাটানো বন্ধের ব্যাপারে মানুষজনকে সচেতন করলে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রিত হয়।
(iv) স্কুটার, মোটর সাইকেল, মোটরগাড়ি ইত্যাদির অযথা হর্ন ব্যবহার না করলেও শব্দ দূষণ কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয়।
আশা করছি শব্দ দূষণ সম্পর্কে (শব্দ দূষণ কাকে বলে) আপনার সমস্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে সাহায্য করতে পেরেছি। নিচে কমেন্ট করে অবশ্যই আপনার মতামত জানাবেন।
AnswerChamp সাইটটি প্রতিদিন ফলো করবেন এই ধরনের সুন্দর সুন্দর তথ্য বাংলায় পাওয়ার জন্য। ধন্যবাদ।।